গিউলিয়া তোফানাঃ এক বিষের জাদুকর
গিউলিয়া তোফানাঃ
গিউলিয়া তোফানা এমন একজন মানুষ
যে শত শত খুন করার পরও যাকে হিরো ভাবা
হয়। যারা তার কাজকর্মকে সমর্থন করেছে
তারা কোনো না কোনোভাবে তার এই খুনের সাথে জড়িত
হওয়া ঘটনাগুলো যুক্তি দিয়ে মেনে নিয়েছে। গিউলিয়া তোফানা আনুমানিক ১৬২০ সালে
জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৬৫৯ সালে। যার তৈরিকৃত বিষে মারা গেছেন
অন্তত ৬০০ জনের
মত। গিউলিয়া তোফানা বিষ প্রয়োগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটি নিদিষ্ট শ্রেণীর মানুষ
কে হত্যা করতেন। তিনি
তাদের ই হত্যা
করতেন যাদের বেঁচে
থাকার অধিকার নেই মনে করতেন।
যে বিখ্যাত বিষ এর প্রস্তুতকারক হিসেবে তিনি পরিচিত সেই বিষ হল একুয়া তোয়াফানা। গিউলিয়া তোফানার নামেই যার নামকরণ। এবং এই বিষ এতটাই ভয়ংকর ছিল যে মৃত্যুর পর মৃতদেহের ময়নাতদন্তেও সেই বিষের উপস্থিতি ধরা পড়ত না। গিউলিয়া তোফানাকে মনে করা হয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর মহিলা সিরিয়াল কিলার।
তবে ইতিহাসের এই খুনী সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য
পাওয়া যায়নি। যতটুকু জানা
যায় তোফানা ১৬২০
সালে ইটালির দক্ষিণাঞ্চলের পালেরমো(Palermo) শহরে
জন্মগ্রহণ করেন। তার একটি
মেয়ে আছে জানা
যায় যদিও এর বেশি সেই মেয়ে
সম্পর্কে আর কিছু
জানা যায়নি। সেই সময়ে
বিভিন্ন বিষ এবং বিষজাতীয় দ্রব্যের প্রয়োগ ছিল্ল খুব সাধারণ ঘটনা। এবং অনেকেই ছিলেন যারা একে পেশা হিসেবে নিতেন।
একুয়া তোফানাঃ
সেসময় যে বিষগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় ছিল সেগুলো হল, কান্তারেলা, স্ট্রিকিনিন, হেমলক, বেলাডোনা, ফক্সগ্লোভ, একুয়া তোফানা এবং আর্সেনিক। গিউলিয়া তোফানার মার্কেটিং কৌশল ভিন্ন ধরণের ছিল। তোফানা বিষ বিক্রি করতেন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মহিলাদের কাছে। যারা জীবনে অসুখী ছিলেন। সেই সময়ে বিবাহ পদ্ধতি ছিল আগে থেকেই ঠিক করে রাখা। এবং কেউ বিবাহিত জীবনে অসুখী হলে কিংবা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও ডিভোর্স এর কোনো কার্যকরী পদ্ধতি ছিলনা। অনেক নারীই ছিলেন যারা স্বামীর হাত থেকে মুক্তি চাইতেন।
অনেক নারীই তোফানার কাছে আসতেন। এবং দারিদ্রতাসহ বিভিন্ন ভয়ংকর ভয়ংকর নির্যাতনের কথা বর্ণনা করতেন যা তাদের উপর ঘরে করা হত। তোফানা তাদের সাহায্য করতে চাইতেন। এবং স্বামীসহ পারিবারিক এসব নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিধবা হওয়ার মাধ্যমে তাদের মুক্ত করতে চাইতেন। তিনি ইটালির দক্ষিণের দিকে বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসা শুরু করলেন। তার সবচেইয়ে জনপ্রিয় দ্রব্য ছিল একুয়া তোফানা নামক বিষ। যা তিনি পাউডার মেক-আপ হিসেবে বিক্রি করতেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একুয়া তোফানা কোনো
মেকাপ সামগ্রী ছিলনা। এটি ছিল আর্সেনিক, লেড এবং বেলাডোনার এক মিশ্রণ। আলাদাভাবে এই তিনটিই এক একটি
ভয়ানক বিষ। তবে এই তিন বিষের মিশ্রণে তৈরি নতুন বিষ এর ধারণা তোফানার মাথায় এসেছিল নাকি
তার মা থোফানিয়া ডি আদেমো এর মাথায় এসেছিল তা জানা যায়না। একুয়া তোফানা এতটাই ভয়ংকর বিষ ছিল যে এর ৪ ফোটা ই যথেষ্ট ছিল একজন
মানুষ এর মৃত্যুর জন্য।
তোফানার প্ল্যান ছিল দরিদ্র মহিলারাও যেন এই বিষ ক্রয় করতে পারে সেভাবে তৈরি এবং বাজারজাত করা। যেন সব শ্রেণির মহিলারাই এটা কিনতে পারেন। এবং এতে ব্যবসা ও হবে লাভজনক। একুয়া তোফানা ছিল বর্ণহীন, স্বাদহীন এবং গন্ধহীন বিষ। একটি ছোট বোতলে করে একুয়া তোফানা বিক্রি হত। এবং বোতলের গায়ে সেন্ট নিকোলাস(Saint Nicholas) এর ছবি থাকতো। এই বোতল শোভা পেত অনেক নারীর ড্রেসিং টেবিলে অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর সাথেই। এর বোতলের ডিজাইন ই এমন ছিল যে ভুলেও কেউ সন্দেহ করতে পারতো না।
যেভাবে ধরা পড়েন গিউলিয়া তোফানাঃ
তোফানার বিষের
ব্যবসা এভাবে ভালোই
চলছিল। কিন্তু সমস্যা বাঁধল ১৬৫০ সালের
দিকে। তোফানার এক নারী গ্রাহক এক অঘটন বাঁধিয়ে বসলেন। সেই নারীর সাথে তার স্বামীর সম্পর্ক ভালো
যাচ্ছিলো না। একদিন সেই নারী তোফানার কাছ থেকে একুয়া তোফানার একটি বোতল নিয়ে
যান। এবং স্বামীর জন্য তৈরিকৃত স্যুপ
এ মিশিয়ে দেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওই মহিলার মন পাল্টে যায় এবং সে তার স্বামীর হাত থেকে স্যুপ এর বাটি কেড়ে নেয়। ওই মহিলার স্বামীর এতে সন্দেহ হয় এবং সে তাকে জেরা
করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সেই মহিলা
তোফানা এবং তার বিষ এর কথা সব বলে দেয়। এবং পরে তার স্বামী এই খবর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে।
কিন্তু সুন্দরী তোফানা ছিলেন অনেক জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তার কারণে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এরপর তোফানা এক চার্চের কাছে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন এবং চার্চ তার আবেদন মঞ্জুর করে। এরই মধ্যে এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তোফানা রোম এবং এর আশেপাশের এলাকার পানিতে তার তৈরিকৃত একুয়া তোফানা বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। এই গুজবের পর পুলিশ আবার নড়েচড়ে বসে এবং জোর করে চার্চ থেকে তোফানা কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিভিন্ন টর্চারের পর তোফানা স্বীকার করে তার তৈরিকৃত বিষে শুধু রোমেই
১৬৩৩ থেকে ১৬৫১
সালের মাঝে প্রায়
৬০০ জন মানুষ
মারা গিয়েছিল। ১৬৫৯ সালে
তোফানাকে তার মেয়ে
এবং তাদের ৩ জন গৃহ পরিচারিকা সহ দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়া
হয়। সে বছর ই তোফানা সহ তার মেয়ে এবং সাহায্যকারীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এভাবেই শেষ হয় গিউলিয়া তোফানা নামক এক নীরব
ঘাতকের গল্প।
إرسال تعليق